শাহাবুদ্দিন সিকদার, চরফ্যাশন
চরফ্যাসন উপজেলার চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় আগের মতো এখন আর লাঙ্গল দিয়ে গরু টানা হাল চাষ চোখে পড়ে না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় হালচাষের পরিবর্তে এখন ট্রাক্টর অথবা পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করা হয়।
এক সময় উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে কৃষক গরু পালন করতো হাল চাষ করার জন্য। আবার কিছু মানুষ গবাদিপশু দিয়ে হাল চাষকে পেশা হিসেবেও নিত। নিজের সামান্য জমির পাশাপাশি অন্যের জমিতে হাল চাষ করে তাদের সংসারের জীবিকা নির্বাহ করতো। হালের গরু দিয়ে দরিদ্র মানুষ জমি চাষ করে ফিরে পেত তাদের পরিবারের সচ্ছলতা। সে সময় দেখা যেত কাকডাকা ভোরে কৃষক গরু, লাঙ্গল, জোয়াল নিয়ে মাঠে বেরিয়ে পড়তো। এখন আর চোখে পড়ে না গরুর লাঙল দিয়ে চাষাবাদ। জমি চাষের প্রয়োজন হলেই অল্প সময়ের মধ্যেই পাওয়ারটিলারসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে করছে চাষাবাদ। তাই কৃষকরা এখন পেশা বদলি করে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। ফলে দিন দিন কমে যাচ্ছে গরু-মিহষ দিয়ে হাল চাষ।
মাদ্রাজের নাজিমুদ্দিন গ্রামের মো. রফিজ মিজি (৭০) বলেন, ছোটবেলায় হাল চাষের কাজ করতাম। বাড়িতে হাল চাষের বলদ গরু ছিল ২-৩ জোড়া। চাষের জন্য দরকার হতো ১ জোড়া বলদ, কাঠ লোহার তৈরি লাঙল, জোয়াল, মই, লরি (বাঁশের তৈরি গরু তাড়ানোর লাঠি), গরুর মুখে টোনা ইত্যাদি। আগে গরু দিয়ে হাল চাষ করলে জমিতে ঘাস কম হতো। অনেক সময় গরুর গোবর জমিতে পড়ত, এতে করে জমিতে অনেক জৈব সার হতো, ক্ষেতে ফলন ভালো হতো। এখন নতুন নতুন মেশিন আইছে, মেশিন দিয়ে এখানকার লোকজন চাষাবাদ করে। আমাগো তো ট্যাকা নাই মেশিন কিনে জমি চাষ করার, তাই এহন সংসার চালাইতে অনেক কষ্ট হইতেছে।
চর কলমির এলাকার কৃষক জান্টু মাতাব্বর জানান, গরুর লাঙল দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৪৪ শতাংশ জমি চাষ করা সম্ভব। আধুনিক যন্ত্রপাতির থেকে গরুর লাঙলের চাষ গভীর হয়। জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি ও ফসলের চাষাবাদ করতে সার কীটনাশক সাশ্রয় পায়। তাই কষ্ট হলেও প্রায় ৪০ বছর ধরে গরুর লাঙল দিয়ে চাষাবাদ করে আসছি। এখন চরাঞ্চল থেকে বিলুপ্তির পথে গরু-মহিষের টানা হাল চাষ।
বিছিন্ন দ্বীপাঞ্চল গুলোতেও এ গরু-মহিষের টানা লাঙ্গল দিয়ে হাল চাষ এখন হয় না। সেখানেও উন্নত প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে।
মাদ্রাজ ইউনিয়নের ইউপির সদস্য জামাল খাঁ বলেন, আমার পিতা এক সময় গরুর হাল চাষ করত আমি বিলে ভাত নিয়ে যেতাম। এখন নতুন উন্নত প্রযুক্তি আসায় সেই গরু বাবা বিক্রি করে দিয়েছে। এখন আর লাঙ্গলটানা হাল চাষ চোঁখে পড়েনা। তা যেন অতীত হয়ে গেছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো আবু হাছনাইদ বলেন, যতই দিন অতিবাহিত হচ্ছে ততই প্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে। একদিন লাঙ্গল নিয়ে যে জমি চাষ করা যায় তার চেয়ে ২০ গুণ বেশী চাষাবাদ করে উন্নত প্রযুক্তি ট্রাক্টর। সরকারও বর্তমানে কৃষকদের জন্য ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষকদেরকে কাছে জমি চাষাবাদের যন্ত্র দেয়া হচ্ছে। যে হারে দেশে মানুষ বাড়ছে কিন্তু সে হারে জমি বাড়ছেনা।ফলে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে চাষাবাদের ফলে আজ দেশ খাদ্যে স্বয়ং সম্পন্ন হয়েছে। খাদ্যের কোন অভাব নেই। দেশে কাজের বুয়ার হাতেও আজ মোবাইল ফোন রয়েছে। নারী ক্ষমতায়নে দেশ এগিয়ে চলেছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুহুল আমিন বলেন, আমি যখন স্কুলে পড়া লেখা করছি যখন পিতা ও চাচারা লঙ্গল দিয়ে জমি চাষাবাদ করছে। জমি চাষ করাই ছিল আনন্দের বিষয়। জমিতে জোড়া জোড়া গরু-মহিষ ছিল হাল চাষের জন্যে। আজ আমাদের চোখে তা পড়েনা। কালের বিবর্তে তা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদীন বলেন, আমাদের চরফ্যাসন বাজার লঙ্গল বিক্রির জন্যে সদর রোডে একটি হাট বসতো। উপজেলা বিভিন্ন স্থান থেকে আসা কৃষক লাঙ্গল ক্রয় করত। কিন্তু এখন আর ও লাঙ্গল তৈয়ারী হাট বসেনা। কৃষকও লাঙ্গলের জন্যে ভীর জমায়না।
বাজার ব্যবসায়ীরা জানায়, এক সময় লাঙ্গল হাটের পাশাপাশি মানুষের হাট বসতো। আর কৃষক মানুষের হাট থেকে কাজের কামলার জন্য কৃষক কিনে নিত হাটের মানুষগুলো। এখন আর তা দেখা যায় না।