ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম এবং বাঙ্গালী জাতি

0
15

মো: রবিউল আলম প্রধান
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চ শক্ষিায় দেশের বৃহৎ এবং প্রথম বিদ্যাপিঠ। বৃটিশ শাসনামলে অবহেলিত জনপদ গুলোর অন্যতম ছিল পূর্ববাংলা। মুসলিম অধ্যুষিত এ অঞ্চলে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে পিছিয়ে ছিল আজকের এই বাংলাদেশ। ফলে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয় বাংলার মানুষ। ১৯১১ সালে বঙ্গ ভঙ্গ রদ আনুষ্ঠিকভাবে ঘোষণার পর বাংলার মানুষ বিশেষ করে মুসলিম জনগোষ্ঠির মধ্যে বৃটিশ বিদ্বেষী মনোভাব তীব্র আকার ধারণ করে। বাংলার বিভক্তি রদ হয়ে যাবার ফলে জনগণের মধ্যে যে, অ-সন্তোষ দেখা দেয় তা সরজমিনে দেখার জন্য তৎকালীন বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে পূর্ব বাংলায় আসেন। তখন নবাব সলিমুল্লাহ, নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী, এ কে ফজলুল হকসহ বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক বড় লাটের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তারা বলেন, বঙ্গ ভঙ্গ রদের কারণে এই অঞ্চলে শিক্ষা-দীক্ষা চরমভাবে পিছিয়ে পড়েছে, ফলে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব করেন তারা। বড় লাট প্রস্তাবটি মেনে নেন এবং ওই বছর একটি সরকারী ঘোষণায় প্রস্তাবটি পাশ হয়।

১৯১২ সালে ব্যারিষ্টার নাথানের নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার রিপোর্ট পেশ করেন। ১৯১৩ সালে নাথান কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হয় এবং একই বছর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক রিপোর্টটি অনুমোদিত হয়। ১৯১৪ সাল প্রেথম বিশ্বযুদ্ধের দোহাই দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত পরিকল্পনা স্থগিত করা হয়।

১৯১৭ সালে ৭ মার্চ নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী ভারতীয় বিধান সভায় বিষয়টি পুনরায় উপস্থাপন করলে সরকার এ ব্যাপারে পুর্ণ আশ্বাস প্রদান করে এবং ১৯১৭ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সলের লর্ড জম্সে ফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা ও চাহিদা নির্ধারণ করার লক্ষ একটি কমিশন গঠন করেন। ১৯১৯ সালে ড.এম ই স্যাডলারের নেতৃত্বে স্যাডলার কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশন এর প্রতিবেদনে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যথার্থতা স্বীকার করা হয়। ১৯১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা পরিষদে পেশ হয় এবং ১৯২০ সালে গভর্নর জেনারেল কর্তৃক চুড়ান্ত অনুমোদন লাভ করে। একই বছর ভারতীয় বিধান সভায় গৃহীত বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের শুরুতে থাকে ৩টি অনুষদ, ১২ টি বিভাগ, ৬০ জন শিক্ষক, ৩টি আবাসিক হল ও ৮৭৭ জন ছাত্র /ছাত্রী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এটি জাতির বিবেক এবং অভিভাবক। জাতির যে কোনো সংকটকালীন সময়ে পাশে দাড়িয়ে উত্তরণ ঘটিয়েছে সমস্যার। সময়ের আবর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজ আমলের সম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, ’৫২- এর ভাষা আন্দোলন, সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, স্বাধকিার আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৯ এর গণ অভুথান এবং ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ ও নেতৃত্ব দেয়। বাংলাদেশ আমলে ১৯৮২ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ’৯০- এর গণ আন্দোলন এবং ১৯৯৬ সালের গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দাবির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়।

১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫তম সমাবর্তন এ বাঙ্গালী ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার বলেছেন, ১‘বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ কখনই নিছক যুক্তিবিদ বা সংকীর্নমনা বিশেষজ্ঞ তৈরি করা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করবে এমন যোগ্য নেতা, যিনি যে কোনো সমস্যার সামগ্রিক চিত্র উপলব্ধি করতে পারেন এবং সবাইকে নিয়ে তা সমাধানের সমন্বতি পন্থা আবিষ্কার করবেন।’

১৯৩৮ সালে ১৭তম সমাবর্তনে আর সি মজুমদার লিখেন,‘বিশ্ববিদ্যালয় শুধু স্কুল কলেজর পরবর্তি ধাপ নয়, মানুষকে জানাতে হবে যে বিশ্ববিদ্যালয় কারিগরী শিক্ষাদানের কোন স্থানও নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আছে; সে গুলো হলো জ্ঞান বিতরণ এবং জ্ঞান অনুসন্ধানের মাধ্যম শিক্ষার অগ্রগতি নিশ্চিত করা, শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের বিকাশ ঘটানো।’
১৯৪০ সালে ১৯তম সমাবর্তনে ইতিহাসবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজসংস্কারক ও শিক্ষাবিদ এ এফ রহমান বলেন, এ বিশ্ব মঙ্গলের জন্য নিরাপদ সমাজ গঠনের জন্য, সব সময় তরুনদের আত্মত্যাগ চায়। কিন্তু আমি বলব, প্রথমে নিজের মতাদর্শ গঠন করো। আগে আত্মবিশ্বাসী হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে শেখো, অন্যকে অনুসরণ করে নয় বরং নিজের সিদ্ধান্ত, নিজের মতামত নিজেই গড়ে তোলো।”

১৯৭০ সালে ৪১তম সমাবর্তনে রসায়নবিদ, গ্রন্থকার ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরাত-এ-খুদা বলেন, ‘জীবনে যা কিছু তাকে সম্পাদন করতে হবে, তা-ও তাদের এই যোগ্যতার ওপর নির্ভর করবে।’

১ জুলাই ২০২১, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০তম বর্ষ র্পূণ করতে চলেছে। বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস এবং ঐতিহ্য জুড়ে রয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদচারণা ও অবদান। জাতি যে কোন ক্রান্তিকালে দেবদূতের মতো পাশে পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম এবং ১০০ বছরের ইতিহাস মনে করিয়া দেয় তার অবদানের কথা, ভূমিকার কথা, দায়িত্ব বোধের কথা। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর বৃটিশ শাসনামলে,পাকিস্তন আমলে এবং স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তার অভিভাবকদের ভূমিকা দেখতে পাই। ১৯৯৬ হতে ২০২১ পর্যন্ত এই অক্সফোর্ড খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টির তেমন কোন ভূমিকা উল্লেখ করার মত চোখে পড়ে না। তাহলে কি আমাদের আর কোন সমস্যা নেই? না কি বিশ্ববিদ্যালয় আর নেতৃত্বে তৈরি করতে পারছে না?

যদি আমাদের কোন সমস্যা না থাকে তাহলে আমরা উন্নত জাতি গোষ্ঠিতে পৌঁছে গেছি। আর যদি নেতৃত্ব তৈরিতে ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে অনিশ্চিত কোন সময়।

(মো: রবিউল আলম প্রধান, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনষ্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেশন-১৯৮৮-৮৯)।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here