জামাই ষষ্ঠি এখন প্রায় সার্বজনীন

0
128

ইদ্রিস মাদ্রাজী
যুগ যুগ ধরে বাঙালি সংস্কৃতিতে জামাইদের জৈষ্ঠ্য মাসে দাওয়াত করে খাওয়ানো একটা প্রথায় পরিনত হয়েছে। সনাতন ধর্মে এটিকে বলে জামাই ষষ্ঠী। কেউ কেউ বলে থাকেন মধ্যযুগে যখন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সূচনা হয়েছিল ঠিক তখন থেকেই জামাই ষষ্ঠী জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে বাঙালি লোকাচারে। তবে ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় জামাই ষষ্ঠীর কথা উল্লেখ রয়েছে বৈদিক যুগেও যেখানে মায়েরা তার বিবাহিত কন্যার পতিকে গৃহে নিমন্ত্রণ করে পঞ্চ ব্যঞ্জন রন্ধন করে খাওয়ায়। এব্যাপারে আলোচনা-সমালোচনা আছে-তবে এসব উপেক্ষা করে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ভেদাভেদ ভুলে নামে-বেনামে বাংলার ঘরে ঘরে আজো চলছে জামাই ষষ্ঠী উৎসব।

কেন পালন করা হয়
বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী চারিদিকে যখন জৈষ্ঠ্য মাসের সুমিষ্ট ও রসালো ফলের সুগন্ধ মৌ মৌ করে, তখন বাংলার ঘরে ঘরে জামাইকে সমাদর করে নিমন্ত্রণ করা হয়। এক্ষেত্রে জামাই ষষ্ঠীর মধ্যমনি থাকে কন্যার স্বামী অর্থাৎ গৃহের জামাই। এইদিন হিন্দু শাস্ত্রমতে শাশুড়ি মায়েরা ষষ্ঠী দেবীর আরাধনা করেন এবং জামাই ও কন্যার জন্য সন্তানসুখ প্রার্থনা করেন। প্রাচীনকাল থেকে সনাতন ধর্মালম্বী ব্যক্তিরা বহু দেব-দেবীর উপাসনা করে আসছেন। সনাতন ধর্মের প্রতিটি দেবদেবী কোন বিশেষ একটি কর্ম ও তার ফলের জন্য দায়ী। দেবী ষষ্ঠী হিন্দুধর্মাবলম্বীদের এমনই একজন উপদেবতা। যাকে উর্বরতার দেবী বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ দেবী ষষ্ঠীর আশীর্বাদে সন্তান সুখ লাভ করেন।

আদিকাল থেকেই হিন্দু সামাজিকতার একটি অন্যতম অংশ হচ্ছে বিবাহিত কন্যার গৃহে কখনোই তাদের পিতামাতা প্রবেশ করবেন না। অন্তত যতদিন পর্যন্ত কন্যা গর্ভবতী না হতো ততদিন পর্যন্ত কন্যার শ্বশুর বাড়িতে তার পিতা-মাতা পানি পর্যন্ত স্পর্শ করত না। কিন্তু সেই সময় শিশু মৃত্যুর হার এবং প্রসূতির মৃত্যু হার ছিল অধিক। অনেক সময়ই দেখা যেত সন্তান গর্ভে আসলে সেটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে কন্যার মুখদর্শন এর জন্য পিতামাতাকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো। এসময় প্রাচীন তাত্ত্বিকেরা একটি সমাধান নিয়ে হাজির হন। তারা জামাই ষষ্ঠী উদযাপনের বিধান দেন। যেখানে জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে পিতা-মাতা তার জামাইকে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ জানাবে বাড়িতে। এসময় মাতা ষষ্ঠীর পূজা করার মাধ্যমে কন্যার জন্য সন্তান সুখ কামনা করা হবে সেইসাথে জামাইকে আপ্যায়ন করা হবে রকমারি ব্যঞ্জন পরিবেশন করে। জামাই ষষ্ঠী উদ্ভাবনের ফলে সেকালে পিতা-মাতা বছরে অন্তত একবার কন্যার মুখ দর্শন করতে পারত। সেইসাথে জামাইকে আপ্যায়ন করা হতো যার ফলে শ্বশুরবাড়িতে মেয়ে সুখী হতে পারবে বলে ধারণা করা হতো।

লৌকিক কাহিনী
জামাই ষষ্ঠী কে কেন্দ্র করে আরেকটি লৌকিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। একদা এক কন্যা তার শ্বশুর গৃহে মাছ চুরি করে খেয়েছিল এবং মাছ চুরির দোষ চাপিয়ে দিয়েছিল বিড়ালের ঘাড়ে। বলা হয়ে থাকে বিড়াল হচ্ছে ষষ্ঠী দেবীর বাহন। ফলে এতে রাগান্বিত হয় ষষ্ঠী দেবী এবং হারিয়ে যায় ওই কন্যার পুত্র সন্তান। পুত্রহারা মা যখন তার ভুল বুঝতে পারে তখন বনে গিয়ে ষষ্ঠী দেবীর আরাধনায় মগ্ন হয়। এতে সন্তুষ্ট হয়ে ষষ্ঠী দেবী তার পুত্রকে ফিরিয়ে দেয়। এইজন্যই ষষ্ঠী দেবীর অন্য নাম অরণ্য ষষ্ঠী। কিন্তু মাছ খাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই কন্যাকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাকে পিতৃগৃহে যেতে দিত না। কিন্তু সন্তান ফিরে আসলে কন্যার পিতা মাতা তাকে জামাইসহ নিমন্ত্রণ করে গৃহে এবং তখনই গৃহে ষষ্ঠী দেবীর পূজা করার মাধ্যমে জামাইকে বাহারি পাকোয়ান বানিয়ে খাওয়ানো হয়।

উদযাপন
‘জামাই ষষ্ঠী’ নাম থেকেই অনুমান করা যায় যে এই দিনটির দুটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। যার একটি হচ্ছে জামাই আদর অপরটি ষষ্ঠী অর্থাৎ ষষ্ঠী দেবীর পূজা। জামাই ষষ্ঠীর পূর্বে এই দিনকে উপলক্ষ করে মায়েরা তার কন্যার স্বামীকে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ করে থাকেন। এরপর জামাই ষষ্ঠীর দিন সকাল থেকেই শুরু হয় আয়োজন। জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে পূজা করা হয় দেবী ষষ্ঠীর উদ্দেশ্যে। এদিন সকালে মহিলারা দেবী ষষ্ঠীর উদ্দেশ্যে সন্তানের মঙ্গল কামনায় উপবাস করেন এবং পূজা-অর্চনা করে থাকেন। এরপর জামাই গৃহে প্রবেশ করলে তাকে একটি পিঁড়িতে বসতে দেন। কপালে আশীর্বাদে তিলক কেটে হাতে বেঁধে দেয়া হয় হলুদ রং মাখানো দেবী ষষ্ঠীর মঙ্গল সুতা। এ সময় জামাইকে উপহার সরূপ দেয়া হয় বস্ত্রাদি। তবে উপহারের বস্ত্রাদি কন্যাও পেয়ে থাকেন। জামাই ষষ্ঠীর মূল আয়োজন থাকে মধ্যাহ্নভোজের। জামাইয়ের জন্য তৈরি করা হয় হরেক রকম তরিতরকারি মাছ-মাংস মিষ্টান্ন প্রভৃতি। তবে জামাই ষষ্ঠীর বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে ইলিশ মাছ। এদিন বিভিন্ন পদে রান্না করা হয় ইলিশ পরিবেশন করা হয় জামাইয়ের পাতে। পাতুরি, তাজা, পনির, রসা, পোস্ত, ডালনা, দোপেয়াজা, প্রকৃতির বাঙালিয়ানা খাবার সাজানো হয় জামাইয়ের থালা। সাথে তো দই, মিষ্টি, পায়েস, টক প্রভৃতি থাকে। ছিটিয়ে দেয়া হয় গরম ভাতে গাওয়া ঘি। সেই সাথে জৈষ্ঠ মাসে আম জাম কাঁঠাল লিচু সহ পিঠাপুলি তে সাজানো হয় জামাইয়ের ভোজ আয়োজন। অবশেষে শাশুড়িমা তাল পাখায় বাতাস করে পরম স্নেহে জামাইকে খাওয়ান। তবে হ্যাঁ জামাই ষষ্ঠী উপলক্ষে জামাই যখন শশুর বাড়ি আসেন তখন অবশ্যই সঙ্গে করে দই মিষ্টি নিয়ে আসেন। মধ্যাহ্নভোজন সেরে শাশুড়ি মাকে প্রণামের পর প্রণামী হিসেবে নতুন বস্ত্র দেন।

আধুনিক জামাই ষষ্ঠী
জামাই ষষ্ঠী পালন এর পিছনে যে কাহিনীই থাক বা না কেন এটি যে প্রাচীন সময় হতেই বাংলার সংস্কৃতির একটি বিশেষ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বস্তুত যেখানে আধুনিক সময়ে আমরা প্রিয়জনকে স্মরণ করতে বিশেষ দিন যেমন ভ্যালেন্টাইন্স-ডে, মাদারস-ডে, ফাদারস-ডে ইত্যাদি পালন করে থাকি, সেখানে পরিবারের বন্ধন অটুট রাখতে প্রাচীনকালের ঋষি মুনিরাই জামাই ষষ্ঠী পালনের বিধান করেছিলেন। এতে করে যেমন জামাই এর সাথে শ্বশুরবাড়ি সম্পর্ক অনেক বেশি সহজ হতো, তেমনি কন্যা কেউ তার শ্বশুরবাড়িতে পেত প্রকৃত সম্মান। বর্তমানে জামাই ষষ্টির যে আধুনিক মূল্যবোধ প্রকাশ পায় তা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টন সব ভেদাভেদ ভুলে বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। ফুটে ওঠেছে সার্বজনিন রেওয়াজ। মুসলমানরা জামাই ষষ্ঠী কথাটি না বললেও জৈষ্ঠ্য মাস এল জামাইকে আমকাঠলসহ হরেক রকম খাবোরের আয়োজন করে নিমন্ত্রণ করে। বাংলার খ্রীষ্টান-বৌদ্ধরাও এইক রেওয়াজে জামাইয়ের জন্যে রড় রকমের খাবারে আয়োজন করে। সম্প্রতি গ্রাম বাংলার এক গরিব শ্বশুরী তার ঢাকায় থাকা এক ভাইকে মোবাইলে বলতে ষোনা যায়, -‌ভাই কিছু টাকা পাঠান, তিনি বলছিলেন, জৈষ্ঠ্য মাস এসে গেছে জামাই-পুত্রাদের দাওয়াত করে আম-কাঠাল খাওয়াতে হবে না। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ১৯৯২ সালে পাস করে বেড়িয়ে যাওয়া একটি ব্যাচ সাভারের বালিয়াড়িতে আয়োজন করেছে জামাই ষষ্ঠি উদযাপন অনুষ্ঠান। মাহবুব, হান্নান, সরোয়ার, মুশফিকা, রত্না, রবি, কামরুল, জহির, পাশাসহ সেখানে যোগ দিচ্ছে ২০ জোড়া দম্পতি। এতে অংশ নিচ্ছে মুসলমান, হিন্দু, খ্রীষ্ঠান, বৌদ্ধসহ সকল ধর্মের দম্পতিরা। এতেই অনুমেয় এ রীতি এখন বাংলার ঘরে ঘরে অর্থাৎ সার্বজনিন।

সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা
অবশেষে বলতে হচ্ছে, সুদূর প্রাচীনকাল থেকে অদ্যবধি বাংলা সংস্কৃতিতে চলে আসছে জামাই ষষ্ঠী উদযাপন বা মেয়ের শ্বশুর বাড়ীর লোকজনকে আম-কাঠালসহ হরেক রকম খাবার তৈরী করে খাওয়ানোর রীতি। এর এর মাধ্যমে জামাইর সাথে শ্বশুর বাড়ির সম্পর্ক আরো বেশি মধুর ও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কারণ এটি শুধুমাত্র একটি লোকাচার নয় বরং এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে বৈদিক দর্শন, সংস্কৃতি ও সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here